বাংলাদেশ ইস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস- বিলস নেদারল্যান্ড ভিত্তিক সংগঠন মন্ডিয়াল এফএনভি এর সহযোগিতায় বাংলাদেশে তৈরী পোশাক শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষায় সার্বজনীন পেনশন স্কীমের ভূমিকা শীর্ষক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরতে এবং শ্রম সংস্কার কমিশন বরাবর সুপারিশ প্রদান করতে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারী) রাজধানীর শ্রম ভবনে একটি বৈঠকের আয়োজন করে।
বিলস এর ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ, ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ, মালিক সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গবেষক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল তুলে ধরেন বিলস এর গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম। এতে পেনশন স্কীমের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা যায়, সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় এবং ডিজিটালাইজড পেনশন ব্যবস্থার বিপরিতে শ্রমিকের দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা একটি বড় বাধা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী বা উক্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জন্য প্রযোজ্য প্রগতি স্কিমের সর্বনিম্ন প্রিমিয়াম তুলনামূলকভাবে বেশি, আয়ের ধাক্কা সামাল দেয়ার জন্য কোনও সুরক্ষা নেই বরং ১০ বছরের জন্য অবিরাম প্রিমিয়াম প্রদান করতে হয়, সুরক্ষা স্কিমের অধীনে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোনও প্রত্যাহার/ঋণ সুবিধা নেই, চাকরি পরিবর্তনের অনুমতি নেই, মাত্র ৮% শ্রমিকের একক কারখানায় ১০ বছরের বেশি কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ বাধ্যতামুলক নয়, মুদ্রাস্ফীতি-সমন্বয় বিবেচনা করা হয় না এবং উচ্চ বিনিয়োগের সাথে রিটার্ন কম, যেখানে একই মেয়াদের ব্যাংক ডিপিএস উচ্চ রিটার্ন প্রদান করে। শ্রমিকদের সক্ষমতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শতকরা ৬৪.৭ ভাগ শ্রমিকের মাসিক প্রিমিয়াম পরিশোধের ক্ষমতা নেই, শতকরা ৭৫.৩ ভাগের ইউনিভার্সাল পেনশন স্কিম বিষয়ে সচেতনতা নেই। এ ছাড়া শতকরা ৬১.৩ ভাগ শ্রমিক চাকরির নিরাপত্তা না থাকার কারণে পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী নন।
গবেষণায় যে সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হয় তার মধ্যে ছিল সুরক্ষা স্কিমে ন্যূনতম প্রিমিয়াম এর পরিমাণ কমিয়ে আনা, প্রতিষ্ঠান ও মালিককে বাধ্যতামূলকভাবে স্কিমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সরকারের বাধ্যতামূলকভাবে স্কিমে অংশগ্রহণ করা, সরকার স্কিমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে পারেন এক্ষেত্রে একজন শ্রমিক যে পরিমাণ প্রিমিয়াম দেবেন সরকার তার সমপরিমাণ বা বেশি প্রিমিয়াম শ্রমিক পক্ষে যুক্ত করতে পারেন, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি করে শ্রমিকের অংশগ্রহণে আগ্রহ বৃদ্ধি করা যেতে পারে, শ্রমিকদের সার্বজনীন পেনশন স্কিম ও এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আরো সচেতনমূলক কাযর্ক্রম ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, স্কিমের সুবিধা সম্পর্কিত বিষয়ে শ্রমিকের সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভরসা অর্জনের জন্য একটি যোগাযোগ কৌশল ডিজাইন ও বাস্তবায়ন করা, স্কিমের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকের সচেতনতা বৃদ্ধিতে ও মালিকের সাথে যৌথ দরকষাকষিতে ভূমিকা রাখতে পারেন, পেনশন স্কিমের জন্য সকল পোষ্যকে নমিনি করা এবং সকল বেসরকারী খাতের শ্রমিকের জন্য সমান শোভন পেনশন নিশ্চিত করা।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেক শ্রম সচিব ড মাহফুজুল হক, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ মহিউদ্দিন খান, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাকিউন নাহার, আইএলও ঢাকা অফিসের চিফ টেকনিক্যাল এডভাইজার সৈয়দ সাদ হোসেন গিলানি, সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশ অফিসের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এ কে এম নাসিম, বিলস নির্বাহী পরিষদের সম্পাদক শাকিল আক্তার চৌধুরী, বিলস পরিচালক নাজমা ইয়াসমিন প্রমুখ।
বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের নির্বাহী পরিচালক একেএম আশরাফ উদ্দিন বলেন এই স্কিম পরিচালনার ক্ষেত্রে সকলের ভরসা অর্জন করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে চাকরির নিরাপত্তা নেই সেখানে শ্রমিক স্কিমে অবদান করতে আগ্রহী হবেন না। শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক শামীমা সুলতানা বারি যোগ করেন, পেনশন স্কিম তখনই য্থাযথ অবদান রাখতে পারবে যখন আন্তঃ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যাবে। আইএলও ইআইএস প্রজেক্টের চিফ টেকনিক্যাল এডভাইজার সৈয়দ সাদ হোসেন জিলানী বলেন, আইএলও সবসময়ই সামাজিক সংলাপকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এধরনের পেনশন স্কিম প্রণয়নের ক্ষেত্রে সকল অংশীজনের অংশ গ্রহণ জরুরী। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক মোঃ মতিউর রহমান জানান তাদের অধিদপ্তর এতদিন কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষভাবে মনযোগী ছিল কিন্তু এখন সময় এসেছে শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মহাসচিব ফারুক আহমেদ মন্তব্য করেন, সার্বজনীন পেনশন স্কিমকে জনপ্রিয় করে তোলা যায়নি, প্রস্তাবিত স্কিমের বাস্তবায়নের জন্য আইনগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন আবশ্যক। শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য একেএম নাসিম বলেন স্কিমের ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়া কেমন হবে সেটা নির্ধারণ করা প্রয়োজন, সেই সাথে ফান্ড ম্যানেজমেন্টকে স্বচ্ছ এবং দায়িত্বশীল করতে হবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী সভাপতি মোঃ মহিউদ্দিন খান বলেন প্রস্তাবিত স্কিমে বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা রয়েছে এ ধরনের গবেষণা স্কিমের কার্যকরী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তিনি বলেন, স্কিমের বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। এই স্কিমের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে স্কিম গ্রহণকারীকে মৃত্যু পর্যন্ত মাসিক পেনশন প্রদান করা হবে, যা অন্যান্য স্কিমের থেকে আলাদা। শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান, সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ বলেন দেশে যতরকম সামাজিক নিরাপত্তা স্কিম রয়েছে তারে মধ্যে সমন্বয় করা যেতে পারে। পাশাপাশি শ্রমিকের আস্থার জায়গা তৈরি করতে পেনশন স্কিমের সাথে ব্যাংকগুলোকে যুক্ত করা যেতে পারে। তিনি উপস্থিত সকলকে অবহিত করেন শ্রমিকের তথ্যভান্ডার, সামাজিক নিরাপত্তা সংস্কার কমিশনের প্রথম অগ্রাধিকার।
বৈঠক শেষে গবেষণা প্রতিবেদনটি শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ এর কাছে তুলে দেওয়া হয়।