মিয়ানমারের চলাচল গৃহযুদ্ধের সংঘাতে প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের টেকনাফের স্থলবন্দরে। সীমান্ত এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যেও পড়েছে হ্রাস। টেকনাফ সীমান্তের সাথে ঘেঁষা মিয়ানমারের মংডু শহর বর্তমানে আরাকান আর্মির দখলে। যার কারণে আরাকান আর্মির প্রতিবন্ধকতার কারণে জলপথ দিয়ে পণ্যবাহী ট্রলার আসতে দিচ্ছেনা বলে দাবী করছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে সরকার হারাচ্ছে শত কোটি টাকার রাজস্ব।
এদিকে, টেকনাফ স্থল বন্দরের সঙ্গে মূলত পণ্য আমদানি-রফতানি হয় মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর হয়ে। রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে পড়েছে এই আকিয়াব বন্দর। টেকনাফের উল্টো পাশে নাফ নদীর ওপারেই মংডুর অবস্থান। টেকনাফ স্থলবন্দর থেকে শহরটির দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে বহু দূরত্বের। টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য প্রায় অচল হয়ে পড়ায় বিপাকে পড়েছেন এ বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবীরা।
স্থলবন্দরের কাস্টমস সূত্রের মতে জানা যায়,গত এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার থেকে কোনো পণ্যেবাহী ট্রলার আসেনি। সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে গত ৩ ডিসেম্বর পণ্যবাহী জাহাজ এসেছিল। তবে আমাদের সরকার সে দেশের দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে,খুব শীঘ্রই ভালো ফল আসবে।
সম্প্রতি সীমান্ত পরিদর্শনে এসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফট্যানেন্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে আর দেশটি চালাচ্ছে জান্তা সরকার। তাই দুই পক্ষের সাথেই যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ। আমাদের স্বার্থ রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে প্রথম থেকে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির যোগাযোগ রাখছি ।

বন্দরের কাস্টম কর্মকর্তারা জানান, গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের ২৩ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৭ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে সরকার ২৫৭ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। গেল (২০২৪-২৫) অর্থ বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার মেট্রিক টন আমদানি হয়। যার ফলে সরকার ৮৭ কোটি টাকা রাজস্ব পায় ।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের যুদ্ধের প্রভাবে গত বছরের তুলনায় ১৭০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। অন্যদিকে, গত দুই অর্থ বছরে যেসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিমেন্ট। গত ২৩-২৪ অর্থ বছরের সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে ২৩৬ মেট্রিক টন। যার মূল্য ১ কোটি ১৩ লাখ টাকার অধিক। এছাড়া চলতি ২৪-২৫ অর্থ বছরে ২৯১ মেট্রিক টন সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে। যার মূল্য ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টেকনাফ স্থলবন্দর এলাকায় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের কোনো দেখা দেখা যায়নি। বন্দর এলাকার আশেপাশের দোকানপাট ও জেটিঘাটগুলো ফাঁকা দেখা গেছে। গত একবছর এগেও যে খানে শতশত ট্রাক সিরিয়ালের জন্য দাড়িয়ে থাকবো আর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের আনাগোনা ছিলো চোখে পড়ার মতো। ঘুরে আসার পথে ব্যবসায়ী খোরশেদ আললের সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, রাখাইনে যুদ্ধের কারণে অনেক দিন ধরে ব্যবসা বন্ধ আছে। এতে আমাদের অনেক লোকজন কর্মহীন দিন কাটছে। আমাদের টাকা ও-ই দেশে জমাও আছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে টেকনাফ বন্দরে মাসে অন্তত ২০০ ইঞ্জিনচালিত বড় বোটে পণ্য আনা-নেওয়া হতো। গত ডিসেম্বরের শুরু থেকে টেকনাফ বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ রয়েছে। ডিসেম্বরে স্থলবন্দর থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় মাত্র ৬ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে আদায় হয় ২০ কোটি টাকা। স্বাভাবিক সময়ে ৪০-৪৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয় টেকনাফ স্থলবন্দরের মাধ্যমে। এছাড়া স্বাভাবিক সময় বন্দরে দিনে ১৫-২০টি নানা ধরনের ট্রলার ও জাহাজ থাকে।
ব্যবসায়ী মনির জানান, প্রতিবেশী দেশটিতে চলমান এই যুদ্ধের প্রভাব শুধু সীমান্তে নয়, কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরেও পড়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এই স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি ৯০ শতাংশ কমে গেছে। এ কারণে একদিকে যেমন পণ্য আমদানি রফতানি হচ্ছে না অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারাচ্ছে সরকার। মিয়ানমারের যুদ্ধপরিস্থিতি দীর্ঘ হলে সেই সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
টেকনাফ বন্দর কাস্টমস কর্মকর্তা বি.এম. আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, মায়ানমার চলমান যুদ্ধের কারণে টেকনাফ বন্দরে মায়ানমার থেকে আমদানি কমে গেলে। গত অর্থ বছরের চেয়ে এই বছরে রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। সর্বশেষ বন্দরে গত ডিসেম্বর মাসে একটি পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে এসেছে। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসে আমদানি হয়েছে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন মালামার। তার পরিবর্তে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২শত ৫৭ কোটি টাকা। পাশাপাশি রপ্তানি হয়েছে ৬৩৬ মেট্রিক টন মালামাল। এবং গত ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বন্দরে পণ্য আমদানি হয়েছে ১১ হাজার মেট্রিক টন মালামাল। রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৭ কোটি টাকা। রপ্তানি হয়েছে ৬৯১ মেট্রিক টন মালামাল।
তিনি বলেন, বন্দরে পূর্বে মায়ানমার থেকে জান্তা সরকারে অধীনে যে মালামাল গুলো বন্দরে আসত সেগুলো আরাকান আর্মি গত ৮ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি মায়ানমার মংডু শহর দখলে নেওয়ার পর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ আসতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে পণ্যবাহী জাহাজ গুলো নির্বিঘ্নে আসতে পারছে না আরাকান আর্মির কারণে। সরকারের পক্ষথেকে জানানো হয়েছে, সরকার দুই পক্ষের সাথে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
টেকনাফ বন্দরের মহাব্যবস্থাপক জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার থেকে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ আসেনি। মূলত রাখাইন রাজ্যে মংডু টাউনশিপ আরাকান আর্মির দখলে যাওয়ার পর থেকে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে আসেনি। তবে সিমেন্টসহ কিছু পণ্য বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে যাচ্ছে।