shrestonews
ঢাকাআজ: শুক্রবার,১লা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ/১৪ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
  • অন্যান্য

বিতর্কিত নির্বাচন, ক্ষমতায় গিয়েও থাকেত পারেনি কোন সরকার

দেবব্রত দত্ত
ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫ ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ । ১৬ জন
Link Copied!
একাত্তর পোস্ট অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও মাত্র ৭ মাসের মাথায় পতন হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে একই বছরের ৫ অগাস্ট পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন ক্ষমতাচ্যুত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা।

তবে গণরোষে সরকার প্রধানের দেশত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম হলেও সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। ১৯৯৬ সালে কম সময়ের মধ্যে সরকারের পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। ওই বছর মাত্র ১১ দিনের মাথায় সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্ববধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার।

এছাড়া আরও দুইবার ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক কোন কোন দলের সরকার ঠিক কবে এবং কোন প্রেক্ষাপটে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যার মেয়াদকাল ছিল মাত্র ১৭ মাস। তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অধীনে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যা বর্জন করে বিএনপি। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তখন ভোটে অংশ নিয়েছিল। নির্বাচনে ছিল জামায়াতে ইসলামীও। ভোটের কয়েক মাস আগে মি. এরশাদের রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি’ আত্মপ্রকাশ করে। নির্বাচনে তারা ১৫৩টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৭৬টি আসন এবং জামায়াতে ইসলামী ১০টি আসন পায়।

১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ দল ভোট বর্জন করে। নির্বাচনে তখন জাতীয় পার্টিসহ মাত্র ছয়টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।

ওই নির্বাচনে সরকারি হিসেবে সাড়ে ৫২ শতাংশ বলা হলেও বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের মতে, ভোট পড়ার হার ছিল আরও অনেক কম। নির্বাচনে ২৫১টি আসনে জয় পেয়ে সরকার গঠন করে জাতীয় পার্টি। বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মওদুদ আহমদ তখন সংসদ নেতা নির্বাচিত হন।

অন্যদিকে, বিরোধী দলের নেতা হন জাসদের আ স ম আব্দুর রব, যিনি তখন ছোট কয়েকটি দলের একটি জোটের নেতৃত্বে ছিলেন। এ দফায় জাতীয় পার্টির সরকার টিকতে পেরেছিল ২ বছর ৭ মাস।

মি. এরশাদ পদত্যাগ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি না মানায় বড় রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আন্দোলন ব্যাপক গতি পায় ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে এবং আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যেও ইস্যুভিত্তিক ঐক্য গড়ে ওঠে। তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট এবং বাম ঘরানার দলগুলোর সমন্বয়ে পাঁচদলীয় জোট গড়ে ওঠে।

এরমধ্যে ১০ অক্টোবর ছাত্রদল নেতা জেহাদ মারা যাওয়ার পর জেহাদের মরদেহ সামনে রেখেই ২৪টি ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করে। এতে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে একই বছরের ১৯ নভেম্বর জোটগুলো আলাদা সমাবেশ করে একটি রূপরেখা ঘোষণা করে, যা তিন জোটের রূপরেখা নামে পরিচিতি পায়।

২৭ নভেম্বর ডা. শামসুল আলম খান মিলন গুলিতে নিহত হলে এরশাদ সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। মূলত এই ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বেই তুমুল আন্দোলন হয়, যার জের ধরে নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে পদত্যাগে সম্মত হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

৪ ডিসেম্বর মি. এরশাদ পদত্যাগ করেন। তিনটি জোটের রূপরেখা অনুযায়ী, তৎকালীন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশে প্রথমবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি ১৪২টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে।

একই বছর দু’বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘটনাও ঘটেছে। আর সেটি হয়েছে সেটি ১৯৯৬ সালে। প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। খালেদা জিয়ার সরকারের অধীনে আয়োজিত ওই নির্বাচনটি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বর্জন করেছিল।

এর ফলে একতরফা ওই ভোটে বিপুল বিজয় পেয়েও ক্ষমতায় টিকতে পারেনি বিএনপি। বিরোধ দলগুলো ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোট বর্জন করলেও সেটার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল আরও দুই বছর আগে। ১৯৯৪ সালে মাগুরা জেলার একটি উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলগুলোর মধ্যে সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলে।

এরপর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে তারা। বিএনপি অবশ্য শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করে আসছিল। কিন্তু দাবি আদায়ে আওয়ামী লীগ ক্রমেই আন্দোলন জোরদার করতে থাকে। তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীও আন্দোলনে যোগ দেয়।

এরমধ্যে পঞ্চম সংসদের মেয়াদ শেষ হয় এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ধার্য করা হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই ওই নির্বাচন করতে হচ্ছে বলে তখন যুক্তি দিয়েছিল বিএনপি সরকার। ২৪ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে সাংবিধানিকভাবে কোন নির্বাচিত সরকার থাকবে না। সেজন্য এই নির্বাচনটিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত’ রাখার নির্বাচন হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।

এ অবস্থায় দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা করানোর জন্য দেশি-বিদেশি কূটনীতিকেরা নানান চেষ্টা চালালেও সব ব্যর্থ হয়। নির্বাচন ঠেকানোর জন্য ১৪ ও ১৫ই ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দেয় বিরোধী দলগুলো। এরমধ্যে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮৯টি আসন পায় বিএনপি।

বাকি ১০টি আসন পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবং একটি আসনে জয় পান তৎকালীন ফ্রিডম পার্টির নেতা সৈয়দ ফারুক রহমান, যিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম স্বঘোষিত হত্যাকারী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে নির্বাচনের আগেই তখন দেশজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। তারপরও নির্বাচনের দিন বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় অন্তত ১০ জন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয় তখনকার সংবাদপত্রে।

যদিও নির্বাচনে পর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি একেএম সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, কত শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে সেটি বড় কথা নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটাই আসল কথা।

নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি সরকার গঠন করলেও বিরোধীদলগুলো তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। ‘অবৈধ সরকার’ আখ্যা দিয়ে তাদের স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানান তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা শেখ হাসিনা।

সেই সঙ্গে, ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ বাতিল করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচন দেয়ার দাবিতে রাজপথেও তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যায় দলটি। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ টানা ১০৮ ঘণ্টার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়, যাতে সংঘর্ষ-সহিংসতায় সারা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

তখন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করেও আন্দোলন দমাতে পারেনি বিএনপি সরকার। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে চাপ বাড়তে থাকায় ১৯৯৬ সালের তেসরা মার্চের ভাষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে তোলার ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

এরপর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো সঙ্গে সরকারের আলোচনা হতে থাকে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং মে মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজি হয় সরকার। তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। এছাড়া ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও সংসদ বাতিল না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে বিএনপি।

১৯৯৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। যার মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন। এরমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে যুক্ত করার জন্য সংসদে বিল উত্থাপন করা হয় ২৪ মার্চ। যা দুই দিনের মাথায় পাস হয়।

১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যেখানে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তার অধীনেই একই বছরের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যার মাধ্যমে ২১ বছর পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরেছিল আওয়ামী লীগ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতা গ্রহণ করলেও তাদের অধীনে পরের তিনটি জাতীয় নির্বাচন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়েও অনেক বিতর্ক তৈরি হয়। বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো ওই নির্বাচন বর্জন করে। সেবার ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও সেই নির্বাচন নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। ভোট কারচুপির কারণে ওই নির্বাচনকে ‘রাতের নির্বাচন’ বলে অভিযোগ করে বিরোধী দলগুলো।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ আরও কয়েকটি দল সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল। এর ফলে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নিরুত্তাপ নির্বাচনে ২২২টি আসনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।