shrestonews
ঢাকাআজ: শুক্রবার,১লা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ/১৪ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
  • অন্যান্য

হুমকিতে বংশ বিস্তার, অবাধে শিকার ডিমওয়ালা কাঁকড়া

খুলনা প্রতিনিধি
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫ ১:১৪ পূর্বাহ্ণ । ৫৬ জন
Link Copied!
একাত্তর পোস্ট অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শিলাসহ ১৪ প্রজাতির কাঁকড়ার প্রজনন হয় সুন্দরবনে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম। এ সময়ে সুন্দরবনে জলজ এ প্রাণীটি শিকার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। তবে বাজারে চাহিদা থাকায় নিষেধাজ্ঞা মানছেন না কাঁকড়া শিকারিরা।

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার, যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ। সুন্দরবনের জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি ও ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া আছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দুই মাস কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম হওয়ায় ৫৯ দিনের জন্য জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশ করে কাঁকড়া ধরার অনুমতি বন্ধ রাখে বন বিভাগ।

প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া রক্ষা করতেই এ উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো। তিনি বলেন, প্রতিবছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দুই মাস কাঁকড়া সুন্দরবনের নদী-খালে ডিম পাড়ে। সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। এ সময়ে তাই কাঁকড়ার প্রজনন নির্বিঘœ রাখতে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

তবে প্রজনন মৌসুমে একটি চক্র নানা কৌশলে কাঁকড়া ধরছে। বন বিভাগের কার্যকর তৎপরতার অভাবে ওই চক্রটি কাঁকড়া ধরা অব্যাহত রেখেছে। এতে সাধারণ জেলেরা যেমন আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন তেমনি কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখার আসল উদ্দেশ্যে ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি বংশবিস্তার এবং সুন্দরবনের জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া রক্ষা করা না গেলে এর এর বংশবিস্তার লোপ পাবে এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে পুরো সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের উপর। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক এ সম্পদ রপ্তানিতেও এর প্রভাব পড়বে।

সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়েকটি উপজেলার কয়েকজন বনজীবী জেলে জানান, কাঁকড়ার ব্যবসা বেশ লাভজনক। যে কারণে প্রজনন মৌসুমেও কাঁকড়া ধরা বন্ধ হচ্ছে না সুন্দরবনে। অধিক লাভের আশায় একশ্রেণীর জেলে বন বিভাগের কাছ থেকে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকার করছেন। প্রায় প্রতিদিনই সুন্দরবনের ভেতর থেকে কাঁকড়া ধরে নৌকায় করে লোকালয়ে নিয়ে আসা হয়। তারপর তা সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার ঘড়িলাল, গোলখালি, আংটিহারা, কাটাকাট, দেউলিয়া এবং দাকোপ উপজেলার নলিয়ান, কালিনগর, কৈলাশগঞ্জ, রামনগর, বাজুয়া, চালনা ও পাইকগাছা বাজারে ডিপোতে বিক্রি করা হয়।

খুলনার পাইকগাছার কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি হীরামন মন্ডল জানান, মূলত খুলনা অঞ্চলের কাঁকড়া চীন, তাইওয়ান, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি করা হয়। খুলনা অঞ্চল থেকে প্রায় ২৫ টন কাঁকড়া প্রতিদিন ঢাকায় পাঠানো হয়। এর মধ্যে খুলনা থেকে পাঠানো হয় সাত টন, সাতক্ষীরা থেকে আট টন, ও বাগেরহাট থেকে ছয় টন।

২০০ গ্রাম ওজনের মাদী কাঁকড়া বিক্রি হয় কেজি প্রতি ২,৫০০ টাকায় এবং ১৮০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রামের কম ওজনেরগুলো বিক্রি হয় ২,২০০ টাকা দরে। অন্যদিকে ৫০০ গ্রামেরও বেশি ওজনের পুরুষ কাঁকড়া কেজি প্রতি ১,৮০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার স্থানীয় কয়েকজন বনজীবী জেলে জানান, সুন্দরবনের নদী-খালে জাল ফেললেই কাঁকড়া ওঠে। এগুলো চড়া দামে বিক্রিও করা যায়। একশ্রেণীর ডিপো মালিক ও আড়তদারা কাঁকড়া শিকারিদের অগ্রিম টাকা দাদন দেন। তারাই সুন্দরবনের প্রভাবশালী কোম্পানি মহাজনদের সহায়তায় অসাধু বনরক্ষী ও কর্মকর্তাদের ঘুষের মাধ্যমে ‘ম্যানজ’ করে বনের নদী-খালে ঢুকে কাঁকড়া শিকারের সুযোগ করে দেন।

বন্ধ মৌসুমে কাঁকড়া শিকারে চ্যালেঞ্জও আছে। সবচেয়ে বড় কাজ হলো ধরার পর কাঁকড়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। জীবিত অবস্থায় সুস্থ আর অক্ষত কাঁকড়া নিয়ে আড়তে ফিরতে না পারলে সেই চালানের কোনো দামই পাওয়া যায় না। ট্রলার নিয়ে বনে ঢোকা যায় না। দূর সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া নিয়ে নৌকা বেয়ে ফিরতে হয় লোকালয়ে। বন বিভাগের চোখ এড়িয়েই কাঁকড়াগুলো সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে নেওয়া হয়। ডিপো ব্যবসায়ীরা কাঁকড়া কিনে ঢাকায় রফতানিকারকদের কাছে পাঠান।

খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলার কয়েকজন বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। কাঁকড়া ধরা বেশ সহজ এবং তা তেমন ব্যয়বহুলও নয়। যে কারণে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার গোনে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার এক শ্রেণীর জেলে বন বিভাগের কাছ থেকে মাছ ধরার অনুমতি নেন। তারপর তারা ‘নিষিদ্ধ’ মৌসুমে চাহিদা বেশি থাকায় সরঞ্জাম নিয়ে সুন্দরবনের নদী-খালে নেমে পড়েন কাঁকড়া শিকারে।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু বনরক্ষী ও কর্মকর্তা কাঁকড়া শিকারিদের সহায়তা করেন। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ বা কাঁকড়ার দু-একটি চালান ধরা পড়লেও বন্ধ হচ্ছে না শিকার। আবার যারা ধরা পড়ছেন তথ্যপ্রমাণের অভাবে তারাও সুন্দরবনের প্রভাবশালী কোম্পানি মহাজনদের সহায়তায় দ্রæত জামিনে বেরিয়ে আবার একই কাজে ফিরছেন।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শুভ্র শচীন বলেন, দাম ও চাহিদা থাকায় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় একশ্রেণীর জেলে সুন্দরবনে অবাধে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকার করেন। এতে কাঁকড়ার বংশবিস্তারের পাশাপাশি সুন্দরবনের জলজ জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু অসাধু বনরক্ষী ও কর্মকর্তা কাঁকড়া শিকারিদের সহায়তা করেন। সুন্দরবন সুরক্ষায় এর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ এবং বনে প্রবেশাধিকার আরো সংরক্ষিত হওয়া দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম। এ মৌসুমে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ। সুন্দরবনে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এই নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে জেলেসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি বনবিভাগের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে। এরপরও কেউ যদি এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কাঁকড়া আহরণ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। চোরাইপথে কাঁকড়া আহরণের প্রবণতা বন্ধে টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

কাঁকড়া শিকারের সঙ্গে বন বিভাগের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।